Posts

বরযাত্রী

শীতের শুরু। লালচে সূর্য শহরের সীমানায় মিশে যাচ্ছে। কুয়াশায় আবছা হতে শুরু করেছে চারপাশ। আগে ফুলে সজ্জিত বরের গাড়ি। হিমেল হাওয়া উড়িয়ে বাস এগিয়ে চলেছে বিয়ে বাড়ির দিকে। বাস ভর্তি বরযাত্রী আনন্দের আবহে মত্ত! খোঁপায়-খোঁপায় ফুলের সুগন্ধে সুরভিত। আদ্দি পাঞ্জাবি-শাড়ি চুইয়ে সুগন্ধি বাতাসে মিশছে। দুপাশে সারি সারি লোকজন বসে; মাঝের একফালি হাঁটার পরিসরে পপুলার হিন্দী ফিল্মের গানে ধুতি-পাঞ্জাবি- শাড়ি পড়ে নাচ! আত্মীয়স্বজন ফুরফুরে মেজাজে। অনেকদিন পর বাড়ির ছেলের বিয়েতে উৎসবের পরিবেশ। পেছনের দিকে মায়ের পাশে বসে হাফ প্যান্ট ছেলেটা আজ বেজায় খুশি। ৯ বছরের ছেলেটার কাছে বরযাত্রী ব্যাপারটা ভীষণ নতুন। ব্লটিং পেপারের মত শুষে নিচ্ছে বাসের ভেতরের ঘটনাবলী। ফাঁক পেলেই বড়দের হাত ধরে সে সবার মাঝে নেচে নিচ্ছে। আনন্দ-উল্লাস-কলধ্বনি মুখর বরযাত্রী। ইতিমধ্যে জটিলেশ্বর মুখোাধ্যায় গেয়ে উঠেছে 'বধুয়া আমার চোখে জল এনেছে হায় বিনা কারণে'! বাকিরাও গুনগুন সুরে গলা মিলিয়ে প্রেমের সুধা পান করছে। 'যেন কিছু মনে করো না কেউ যদি কিছু বলে, কত কিই যে সয়ে যেতে হয় ভালবাসা হলে-'... বশীভূত সবাই অখিলবন্ধু...

ইন্দুবালা ভাতের হোটেল: স্মৃতির স্রোতে ভেসে ইতিহাসের পুনঃপাঠ

Image
  ঋত্বিক ঘটক বলতেন ‘বাংলার আবার এপার ওপার কি’! কিছুতেই দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু দেশভাগের বাস্তবতা কেউ আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। আজও আমাদের পূর্বসূরিরা দেশভাগের অন্ধকারময় বিভীষিকায় আচ্ছন্ন। অসংখ্য মানুষ রাতারাতি বাস্তুহারা হয়ে ঠাই খুঁজে নিয়েছিল্ এদেশের অলি-গলি বা রেললাইন ধারস্থ বস্তিতে। তারপর শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই। আমাদের ঠাঁইনাড়া পূর্বপুরুষেরা ধীরেধীরে নিজেদের গোছাতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে স্বাধিনতার ৭৫ বছর পেড়িয়ে গেছে। সারা দেশজুড়ে সাড়ম্বরে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব ঘটা করে হল পালন। এই প্রজন্মের অনেকের কাছে দেশভাগের স্মৃতি শুধুই রোমান্টিকতা। অনেকেই ইতিমধ্যে বিস্মৃত। ঠিক এরকম স্মৃতিহীনতার সন্ধিক্ষণে দেশভাগের নির্মম অভিঘাত এই কিছুদিন আগেও টের পাওয়া যায় যখন পশিমবঙ্গে এন.আর.সি হওয়ার ভয়ে মানুষজন আত্মহত্যা করে। এই সময় পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্যের নির্মাণ করেছেন ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’- এর মতো ইতিহাস খননকারী সিরিজ। লেখক কল্লোল লাহিড়ী লিখিত উপন্যাস ইতিমধ্যে অসংখ্য পাঠকের ভালবাসা কুড়িয়েছে। একটা জনপ্রিয় বইয়ের চলচ্চিত্রায়ন সহজ ব্যাপার নয়। পাঠকেরা লেখার সাথে সিনেমার গল্পের লাইন ধরে মিল ...
Image
  আমি অনেকদিন যাবৎ বাংলা ছবি দেখিনা। ছবির ট্রেলার দেখেই উৎসাহ জাগেনা, দেখা তো দূর অস্ত! তাই ইদানিং বাংলা ছবি খারাপ কি ভালো সেই নিয়ে বক্তব্য রাখার খোরাক মজুদ নেই। কিন্তু এই সময়ে একটা বাংলা ছবির কথা মনে পড়লো যা শেষ কয়েক বছরে দেখা বাংলা সিনেমাগুলোর মধ্যে বেশ ভালো লেগেছিল। প্রায় বছর তেরো আগে দেখা; 'তিন ইয়ারি কথা'!    ছবিটা একজন স্যার পেনড্রাইভে পুরে দিয়েছিল পকেটে। আমাদের পাড়ায় অনেককে সিডিতে ডিস্ট্রিবিউট করেছি। জলালুর বোম্বে সেলুনে রাত হলেই টিভিতে চালিয়ে দিত। সেলুনে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা হাসতাম দৃশ্যগুলো নিয়ে। যে বন্ধুদের দেখিয়েছিলাম তারা আজও ছবিটার অনেক দৃশ্য মনে করিয়ে মজা করে। ঠিক যেমনটা 'গ্যাংস ওফ ওয়াসিপুর' ছবিটা দেখে হয়েছিল। আমি বস্তি অঞ্চলে মুখে মুখে 'গ্যাংস ওফ ওয়াসিপুর' ছবির সংলাপ ঘুরতে শুনেছি। খুব কম ছবিই ক্ষমতা রাখে মানুষের মনে এরকম জায়গা করে নিতে। 'তিন ইয়ারি কথা' ছবিটার পরিচালক ছিলেন অভিজিৎ গুহ এবং সুদেষ্ণা রায়। সম্ভবত ছবিটা প্রোডিউসার-ডিস্ট্রিবিউটরের ক্যাচালে হলে মুক্তি পায়নি।   এই ছবিতে এমন কি ছিল যে চরিত্রগুলো আজ মনে থেকে গেছে? এ...
Image
চৈত্রের দুপুর। হাওয়ার আলিঙ্গনে অশ্বত্থ গাছের পাতারা মাথা নাড়াচ্ছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা খানখান করে প্রকান্ড মেটে রঙের মালগাড়ি অজগরের মত এগিয়ে চলছে কোন এক দূরবর্তী ঠিকানায়। মন্থর গতি তার দুই পাড়ের অপেক্ষারত মানুষগুলোর ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিতে ব্যস্ত। রেললাইনের একপাশ জুড়ে রয়েছে ক্ষুদ্র তিন কামরার একটা অফিসবাড়ি। রেলের কর্মচারীদের কাজের ফাঁকে জিরিয়ে নেওয়ার আশ্রয়- রেস্টরুম। প্রখর গ্রীষ্মে ইয়ার্ডের মধ্যে টেকা মুশকিল। আগুনের হলকা জানালা সেধিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ভেতরে মানুষজন গরম আঁচে ফুট কড়াইয়ের মত ফুটতে থাকে। রাস্তার ধুলো আপনমনে হাওয়ায় ভেসে অফিসঘর ভরিয়ে তোলে। তবুও রেল কর্মচারীদের কাছে এস্থান স্বর্গ। বাইরের অসহ্য গরমের থেকে এখানে কিছুটা হলেও স্বস্তি! কাজের ফাঁকে অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে গল্পে মশগুল হওয়ার ঠিকানা। প্রচন্ড খাটুনির ফাঁকে একটু জিরিয়ে নেওয়ার আশ্রয়। কয়েকবার উনুনে ফোটানো পুরানো চায়ে চুমক দিতে দিতে বিহারের বাসিন্দা শিবকুমার সদ্য দেশের বাড়ি ঘুরে আসা আরেক সহকর্মী বিজয়ের কাছে জেনে নেয় গ্রামের হালহকিকত। পাশাপাশি গ্রামেই যে তাদের দেশের বাড়ি। এরকমই উত্ত...

অভিষেকের মৃত্যু!

  ছুটির ঘন্টা শুনেই দে ছুট। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি থামার রেশ নেই। সবে বিকেল চারটে; আকাশে চাপচাপ অন্ধকার ইতিমধ্যে জমাট বেধেছে। দ্রুত বাড়ির দিকে পা চালাচ্ছি। মনের ভিসুয়ালে মাঠ জুড়ে বৃষ্টির জলে ডোবা ঘাস-কাদা। এবং বিদ্যুৎবেগে জল সাঁতরে চলা একটা ফুটবল। না জানি এতক্ষণে বন্ধুরা দল করে খেলাও শুরু দিয়েছে। ধুস! বর্ষায় স্কুল বন্ধ রাখতেই পারে।    এসব ভাবতে ভাবতে প্রায় অর্ধেক পথ চলে এসেছি এমন সময় শুনলাম লোকজন বলাবলি করছে- শিশিকলে কারখানায় শুটিং হচ্ছে। সবাই ছাতা মাথায় কেউবা ভিজতে ভিজতে দৌড় সেদিকে। এতদিন সিনেমার সাথে সম্পর্ক বলতে সাদাকালো বেলটেক টিভি ও তাতে সপ্তাহান্তে দুটো চ্যানেলে সিনেমা। নায়ক-নায়িকারা সবাই অন্য গ্রহের বাসিন্দা। শুটিং করতে কি এই কাদা প্যাঁচপ্যাঁচে এদো গলি শিশিকলে আসবে নায়ক-নায়িকারা? খেলা রোজ হবে আগে দেখি শুটিং। ভেজা ব্যাগ জাপটে একদৌড়ে কারখানার গেটে। অগুনতি মানুষের মাথা; হট্টগোল। ভিতরে শুটিং চলছে গেট বন্ধ। সবার আবদারে পেল্লাই গেট শেষ পর্যন্ত খোলা হল। মাথায় কাকুদের বুক সমান হব। ভিড়ের বুক কাটিয়ে মাথা সেধিয়ে চাক্ষুষ করলাম একমাথা কোকড়ানো চুল কার্তিক ঠাকু...

নববর্ষ ১৪২৯

  আজ নববর্ষ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাড়ির উল্টোদিকে মাঠে হাজির। পয়লা বৈশাখ শুরু হবে গোলপোস্ট পুজো দিয়ে। সারা বছর ধরে মাঠে দাপিয়ে ফুটবল খেলার প্রস্তুতি আজ শুরু। পোস্টের গোড়ায় ফুল, ধূপকাঠি দেখিয়ে মিষ্টি বিতরণ হবে। মিষ্টি মুখে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসা। নাকেমুখে খাবার গুঁজে দশটা বাজতে বাজতেই রোদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে মাঠে খেলতে নেমে পড়তে হবে। এভাবে ঘন্টা দু'য়েক কাঠ কয়লার মত পুড়ব। গলা শুকিয়ে রাজস্থানের মরুভূমি হওয়া না পর্যন্ত খেলোয়াড় হওয়ার রেওয়াজ চলতে থাকবে। খেলা শেষ করেই মাঠের পাশে বিশাল ঝিলে একে একে সকলে ঝুপঝুপ করে শূন্যে উল্টো ডিগবাজি খেয়ে আছড়ে পড়ছি। গলা পর্যন্ত জলে ডুবে এক সাবানে সকলের রগরানো চলছে, বিকালে এরকম হনুমানের মত মুখ হলে চলবে না। এসব করে বাড়িতে যখন ফিরেছি পেটে আগুন জ্বলছে। যাই পাতে দিচ্ছে নিমেষে সাবাড়! এমনিতেই মা আজ বাড়িতে সামান্য হলেও সুস্বাদু খাবার রান্না করেছে। খাচ্ছিও দ্বিগুণ। একটু দুপুরে আরাম করেই আবার মাঠে ফুটবল খেলতে দৌড়। সকালে পুজোর সময় একমনে ঠাকুরকে ডেকে বলেছি এমন একটা কিছু করো যাতে এই পায়ে সাইসাই করে গোল তাক করে যেন বল শ্যুট করতে পারি। কিন্ত...

কিছু মানুষের চলে যাওয়া প্রিয়জন হারানোর মতোই বেদনাদায়ক!

Image
গঙ্গার মাঝে লঞ্চ। বাগবাজার ঘাটে ভিড়তে তখনও মিনিট দশেক বাকি। শীত গুটিগুটি পায়ে বিদায় জানালেও এই মাঝ গঙ্গায় নিজের উপস্থিতি হালকা মেজাজে জানান দিচ্ছে। সরস্বতী পুজো সব শেষ হয়েছে, আজ ছিল বিসর্জন। সারাদিন কেটেছে হাওড়ায় এক বন্ধুর বাড়িতে। খানাপিনা, হই হুল্লোড়, আড্ডার মাঝে সারাদিন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই গানের রেশ। সন্ধ্যে সাতটা বাজতেই ছুট গঙ্গার ঘাট। বেশ ফাঁকা ছিল লঞ্চটা; রেলিঙে সামনের দিকে দু'হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে দূরে আবছা অন্ধকারে চোখ। পাড়ে কয়েকটা মিলিট্যান্ট যুবক হালকা কুয়াশার চাদর জড়িয়ে সুর ধরেছে - 'ছোড় আয়ে হাম ও গলিয়া…'! ঘাটের দূরত্ব কমছে যত, সুরের মূর্ছনা ততোই আচ্ছন্ন করছে।   এক বন্ধু সকালেই বলে রেখেছিল আজ প্রোগ্রামে না এলে কিন্তু মিস করবি। কেন কে আসছে?    কে কে আসছে বল! আশা, শান ও কেকে! পাড়ার ফাংশনে পুরো বোম্বে উঠে চলে আসছে।      বাগবাজার ঘাটের কাছে লঞ্চ জেটিতে ভিড়তেই এক লাফ। ততক্ষনে মাচিস ছবির যুবকেরা কুয়াশায় মিশে গেছে। নেমেই দৌড় অটো স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে একটা অটো পাল্টে বাস ধরে সিধে লেকটাউনে। বন্ধু ফোনে এক জায়গায় অপেক্ষা করতে ...