চৈত্রের দুপুর। হাওয়ার আলিঙ্গনে অশ্বত্থ গাছের পাতারা মাথা নাড়াচ্ছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা খানখান করে প্রকান্ড মেটে রঙের মালগাড়ি অজগরের মত এগিয়ে চলছে কোন এক দূরবর্তী ঠিকানায়। মন্থর গতি তার দুই পাড়ের অপেক্ষারত মানুষগুলোর ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিতে ব্যস্ত। রেললাইনের একপাশ জুড়ে রয়েছে ক্ষুদ্র তিন কামরার একটা অফিসবাড়ি। রেলের কর্মচারীদের কাজের ফাঁকে জিরিয়ে নেওয়ার আশ্রয়- রেস্টরুম। প্রখর গ্রীষ্মে ইয়ার্ডের মধ্যে টেকা মুশকিল। আগুনের হলকা জানালা সেধিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ভেতরে মানুষজন গরম আঁচে ফুট কড়াইয়ের মত ফুটতে থাকে। রাস্তার ধুলো আপনমনে হাওয়ায় ভেসে অফিসঘর ভরিয়ে তোলে। তবুও রেল কর্মচারীদের কাছে এস্থান স্বর্গ। বাইরের অসহ্য গরমের থেকে এখানে কিছুটা হলেও স্বস্তি! কাজের ফাঁকে অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে গল্পে মশগুল হওয়ার ঠিকানা। প্রচন্ড খাটুনির ফাঁকে একটু জিরিয়ে নেওয়ার আশ্রয়। কয়েকবার উনুনে ফোটানো পুরানো চায়ে চুমক দিতে দিতে বিহারের বাসিন্দা শিবকুমার সদ্য দেশের বাড়ি ঘুরে আসা আরেক সহকর্মী বিজয়ের কাছে জেনে নেয় গ্রামের হালহকিকত। পাশাপাশি গ্রামেই যে তাদের দেশের বাড়ি। এরকমই উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা মুক্তেশ্বর প্রসাদ পরিকল্পনা করে পুজোয় গ্রামে গিয়ে জমিতে কি ফলাবে এই বছর। এখানে কর্মরত বেশীরভাগ মানুষের বাড়িই বিহার অথবা উত্তরপ্রদেশ। এভাবেই একটা দেশের মধ্যে মিলিত হয় অনেকগুলো দেশ। মানুষ খুঁজে নেয় বিদেশ-বিভুইয়ে এক টুকরো নিজের দেশ। এক সময় ঝাকেঝাকে দুর আকাশে পাখিরা ফিরতে শুরু করে; সূর্য লালচে আভায় ডুব দেয় বিরাট অশ্বত্থ গাছের পাতায়। ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা সুরে আঁধার নামে রেলওয়ে ইয়ার্ডে। প্রয়োজনীয় স্থান ছাড়া হলদেটে আলোর চিহ্ন পাওয়া যায় না। চার ব্যাটারির তীব্র আলোর নিশানায় অন্ধকার চিরে পথের আভাস ফুটে ওঠে। ডিউটি শেষে কর্মচারীদের বাড়ির ফেরার সময় এখন। একে একে তারা পা বাড়ায় রেলের দেওয়া কোয়াটারের উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যে নাইট শিফট ঠিকানায় লোকজন আসতে শুরু করেছে। যদিও রাতে এখানে কাজ কম, নাসিকা গর্জনের প্রতিযোগিতা বেশি চলতে থাকে। এই তিন কামরা ও মালগাড়ির আসা-যাওয়া ব্যতীত সম্পূর্ন নিস্তব্ধ হয়ে ভোরের অপেক্ষায় সময় গোনে চারপাশ। মালগাড়ির হুঙ্কার অন্ধকার জুড়ে বয়ান করতে থাকে স্থানের অস্তিত্ব। ধীরে ধীরে পাখির গুঞ্জন তীব্র হয়ে। ভোরের নরম আলো শাণিত বর্শা ফলকের মত গাঁথতে থাকে গাছপালা-মানুষ। ক্ষীণ হয়ে যাওয়া পাখির গুঞ্জনের সাথে তীব্র হয় সূর্যের তেজ। যে যার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। মর্নিং শিফটের সময় হয়ে আসে। এভাবেই জীবনের যাত্রাপালায় তিন কামরার অফিশঘর মঞ্চের আকার ধারণ করে। তার ঠিক পাশেই লেভেল ক্রসিং দিনভর ওঠানামা করে মঞ্চের পর্দা ওঠা-নামার মতো।










এক এক করে সব পুরানো কর্মচারীরা চাকরী থেকে অবসর নিয়ে ফিরে যায় নিজেদের দেশের বাড়ি। পুরানো মুখ আর দেখা যায় না। ইতিমধ্যে কবে চারদিক ঝলমলে হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষজন, ইয়ার্ড, অফিসবাড়ি কেউ রাখেনি খেয়াল। পাশেই ঝকঝকে আন্তর্জাতিক মানের রেলওয়ে স্টেশন তৈরি হয়েছে। তাকে কেন্দ্র করেই যত উদ্দামতা। ঠিক পাশেই ধুঁকতে থাকা এই স্থান ইতিমধ্যে একদিন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এক সময় ব্রিটিশ সাহেবদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল এই পাকা অফিসঘর। আজও দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় উৎসব মুখরিত কোলাহল। সময়ের নির্মম প্রহারে সেই মুহূর্তগুলো মিশে যেতে থাকে অশ্বত্থ গাছের ডালে, পাতায়, রাস্তার ধুলোয়, ঝিরিঝিরি বাতাসে। সম্পূর্ণ ধ্বংসের অপেক্ষায় প্রহর গোনে অফিসঘরের প্রেতাত্মা!

 

ছবি: সৌরভ বিশ্বাস 

Comments

Popular posts from this blog

বরযাত্রী

কোটি কোটি প্রদীপের আলোও তমসাচ্ছন্ন আকাশ ঢাকতে অক্ষম