কিছু মানুষের চলে যাওয়া প্রিয়জন হারানোর মতোই বেদনাদায়ক!
গঙ্গার মাঝে লঞ্চ। বাগবাজার ঘাটে ভিড়তে তখনও মিনিট দশেক বাকি। শীত গুটিগুটি পায়ে বিদায় জানালেও এই মাঝ গঙ্গায় নিজের উপস্থিতি হালকা মেজাজে জানান দিচ্ছে। সরস্বতী পুজো সব শেষ হয়েছে, আজ ছিল বিসর্জন। সারাদিন কেটেছে হাওড়ায় এক বন্ধুর বাড়িতে। খানাপিনা, হই হুল্লোড়, আড্ডার মাঝে সারাদিন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই গানের রেশ। সন্ধ্যে সাতটা বাজতেই ছুট গঙ্গার ঘাট। বেশ ফাঁকা ছিল লঞ্চটা; রেলিঙে সামনের দিকে দু'হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে দূরে আবছা অন্ধকারে চোখ। পাড়ে কয়েকটা মিলিট্যান্ট যুবক হালকা কুয়াশার চাদর জড়িয়ে সুর ধরেছে - 'ছোড় আয়ে হাম ও গলিয়া…'! ঘাটের দূরত্ব কমছে যত, সুরের মূর্ছনা ততোই আচ্ছন্ন করছে।
এক বন্ধু সকালেই বলে রেখেছিল আজ প্রোগ্রামে না এলে কিন্তু মিস করবি।
কেন কে আসছে?
কে কে আসছে বল! আশা, শান ও কেকে! পাড়ার ফাংশনে পুরো বোম্বে উঠে চলে আসছে।
বাগবাজার ঘাটের কাছে লঞ্চ জেটিতে ভিড়তেই এক লাফ। ততক্ষনে মাচিস ছবির যুবকেরা কুয়াশায় মিশে গেছে। নেমেই দৌড় অটো স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে একটা অটো পাল্টে বাস ধরে সিধে লেকটাউনে। বন্ধু ফোনে এক জায়গায় অপেক্ষা করতে বললো। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটছে। এই শো কোনোভাবে মিস করা যাবেনা।
ন'য়ের দশক সদ্য শেষ। ক্যাসেটের এপিঠ-ওপিঠ পাল্টে গান শোনার যুগেরও ইতি। রাতে টিউশন থেকে বাড়ি ফিরেই এফএম রেডিও চালাই। প্রায় রোজ রাতেই হিন্দি তাজা মুক্তি পাওয়া ছবির গানগুলো বিভিন্ন এফএম চ্যানেলে শুনি। বিনা খরচে অফুরন্ত গান শোনা স্কুল জীবনে কম রোমাঞ্চকর ঘটনা নয়। কেকে, শান, জুবিন, শ্রেয়া ঘোষাল, জেমস, রাহাত ফতেহ আলী খান, আতিফ আসলাম, কুণাল গাঞ্জাওয়ালা, কৈলাশ খেরের হিন্দি গানের সুগন্ধি আতরে আমাদের কৈশোর আচ্ছন্ন। এতো গায়কের মধ্যে কেকে বুকে তুফান তুলছে। একের পর এক হিট। বয়ঃসন্ধিকালের দীর্ঘ দুপুরের সঙ্গী। এরপর সারা বছর ধরে বাজবে পুজোর মণ্ডপে, বিয়ে বাড়ীতে, পাড়ার জলসায় বা নিঃসঙ্গ একাকী চিলেকোঠায়।
সম্ভবত ২০১৪ সাল। শান্তুনুর থেকে পাস নিয়েই অনুষ্ঠানের মাঠের দিকে দৌড়াতে শুরু করেছি। একের পর এক তারকারা স্টেজে ঝকমক করছে। সবে বন্ধুরা চেয়ারে বসেছি; স্টেজে কেকে। মাঠে সবাই উত্তেজিত হয়ে দাড়িয়ে। হাতে মাইক নিয়ে কেকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একের পর এক প্রিয় গানের গায়ক তখন সামনে। নায়কের ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে দর্শকদের মাতানোর কাজে যার জুড়ি মেলা ভার। বিরামহীন কেকের গানে দর্শক আচ্ছন্ন। না, সেদিন 'ছোড় আয়ে হাম ও গলিয়া' কেকের গলায় শুনতে পায়নি। পরে বুঝেছিলাম সব গান ভিড়ের সমুদ্রে পারফর্ম করার জন্য নয়। কিছু সুর একাকী শোনার জন্যই তৈরি হয়।
কিছু মানুষের চলে যাওয়া প্রিয়জন হারানোর মতোই বেদনাদায়ক। শেষবার মনে এরকম আঁচড় কেটেছিল ইরফানের মৃত্যু। এরা শুধু শিল্পী নয়, মানুষ হিসেবেও সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় অজস্র মানুষের উপচে পড়া শ্রদ্ধার্ঘ্য তার প্রমাণ। যা একি সাথে হতবাক করে ও বিস্ময় জাগায় মনে। এই মানুষে-মানুষে ঘৃনা জাগানো সময়ের মাঝে সবাইকে এক সুতোয় বেধে একত্রিত করতে একটা মৃত্যুর প্রয়োজন হয়। হিংসা, ঘৃনা, সাম্প্রদায়িকতা ভুলে একজন শিল্পীর মৃত্যু পারে ক্ষণিকের জন্য মানুষের মনের পচন রোধ করতে। একটা সভ্য দেশের নাগরিকের কাছে যা হয়তো কাম্য নয়।
Comments
Post a Comment