'বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা'- পাইন কাঠের বাক্সে আগলে রাখা সেপিয়া টোনের স্মৃতি
আমার বাবার ছিল একটি ইয়াশিকা ক্যামেরা। সেই সময় অনেকের বাড়িতেই ছিল, আবার অনেকের ছিলনা। এক সময় কোন এক কারণে বাবা সেই ক্যামেরাটি তারই এক বন্ধুর কাছে হস্তান্তরিত করে। এরপর সেই ক্যামেরা আর বাড়িতে ফিরে আসেনি। কিন্তু ইতিমধ্যে ক্যামেরা তার ভাগের কার্য সম্পন্ন করে রেখে গেছে। একটা অ্যালবাম জুড়ে বাড়ির সদস্যদের ছবি। বেশিরভাগ বাবাই শখ করে তুলেছিল। বাবা-মায়ের বিয়ে থেকে শুরু করে আমার ভূমিষ্ঠ হওয়া অব্দি মুহূর্তগুলি, বাদ নেই কিছুই। সেই সময় মানুষ নিজেদের স্মৃতিকে এভাবেই আগলে রাখত। একটা বয়েসের পর আর ছবি নেই। ততদিনে ক্যামেরাও যে অন্য হাতে ক্লিক ক্লিক সুরে বেজে উঠছে। যতদিন ছিল সে আমাদের মুহূর্তগুলো বন্দী করেছে। অনেকদিন পরে যা আমাকে অনেক কিছু মনে করিয়ে দেবে। আমার পূর্ব-পুরুষেরা দেশভাগের ক্ষত নিয়ে কিভাবে এদেশে থিতু হয়েছিল তার স্মৃতি কিছুটা উসকাবে। একটা অনুষ্ঠানে সবাই একত্রে জড়ো হয়ে হাসিমুখ দেখে বুঝতে শিখবো কিভাবে সেই মানুষগুলো সব কিছু হারিয়ে এসে শত লড়াইয়ের মধ্যে দিন গুজরান করে থিতু হয়েছিল এদেশে, মুখে ফুটেছিল হাসি।
ছবির কাজই হোল স্মৃতি উস্কে দেওয়া। অনেকদিন পরেও বিস্মৃত ঢের কিছু মনে করিয়ে দেওয়া। ঠিক যেভাবে লেখক কল্লোল লাহিড়ীকে তার বাবার কোন এক কালে তুলে রাখা ছবির চরিত্রগুলো একদিন লিখিয়ে নেবে তাদের বিস্মৃত জীবনের কাহিনী। একে একে তাতে জায়গা করে নেবে লেখকের বাবা, মা, বড়ো মণি, ঠাম্মা, দাদা ও হাঁদা। নিজের হকের দাবি আদায় করে নেবে একশো কুড়ি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের বাড়ি। যে বাড়িটি জুড়ে ছিল লেখকের ছেলেবেলা ও অনেক স্মৃতি। পাইন কাঠের বাক্সের মধ্যে আগলে রাখা সেপিয়া টোনের স্মৃতি কালির হরফে ছাপা হবে বইয়ে। স্থিরচিত্র লেখার জাদুবলে রুপান্তরিত হবে চলচ্চিত্রে। চরিত্রগুলোর সাথে জড়িয়ে সেই সময়কাল। এতকাল পাখি পড়ার মতো আউরে আসা ইতিহাসকে এক অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে অনুধাবন করবো। ইতিহাস মানে যে শুধুই রাজা-রাজড়ার জীবনী নয়; সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দিনযাপনেরও আখ্যান!
এই লেখা গ্রন্থ সমালোচনা নয়। আমার স্বল্প জ্ঞানে সেটা এক প্রকার ধৃষ্টতার সামিল হবে। 'বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা' নামক বইটা পড়ার পর আমার পাঠ অনুভূতি লিখছি। বইয়ের বিষয়বস্তু নামকরণ থেকেই অনুমেয়। লেখকের বাবাকে তার বিলেত নিবাসি এক বন্ধু ইয়াশিকা ক্যামেরা উপহার দিয়েছিলেন। লেখকের বাবার ছিল ছবি তোলার শখ। সেই ক্যামেরায় ছবিও তুলেছিলেন বিস্তর। সময়ের সাথে বাবার শারীরিক অসুস্থতায় সেই শখ নির্বাসিত হল। এক সময় বাবাও গত হলেন। কিন্তু রয়ে গেল ছবিগুলো। অনেক বছর পর যা একের পর এক জুড়ে এগারোটি পরিচ্ছেদে রচনা হল পরিবারের স্মৃতিচারণা। ইতিহাস। কিন্তু তা নিছক ব্যাক্তিগত নয়। সেই স্মৃতিকথা লেখকের ব্যাক্তিগত পরিসর ভেদ করে তার বৃত্ত ছুঁয়ে যায় ইতিহাসের এক সময়কালকে। যে সময়কাল জুড়ে কনশেনট্রেশান ক্যাম্প, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেভাগা, দাঙ্গা,নকশাল আন্দোলন হয়ে ২০১৯ সালের রাস্তায় গণ আন্দোলন। তাই যখন দেশভাগের শিকার আর হাজারো গুছিয়ে না নিতে পারা পরিবারের ভিরে লেখকের পরিবারকে এক সারিতে দেখি, বুঝতে অসুবিধে হয়না যে দেশভাগের বিষাক্ত আঁচড় আজো কিভাবে পিঠে ক্ষতচিহ্ন এঁকে চলেছে। এখনও দেখি নেতারা মানুষের পিঠে কাঁটাতারের দাগের ক্ষত খুঁজে নেওয়ার আমোদে মজে। অথচ কে চায় তার জন্মভুমি ছেড়ে আসতে? যাদের জন্য দেশটা দু-টুকরো হল একবারও কি আমরা তাদের পিঠের জামা খুলে ক্ষতচিহ্ন খোঁজার চেষ্টা করেছি? ভাবায় সে প্রশ্ন। স্বাধীনতার নামে প্রতিবেশি দেশগুলো একে ওপরের সাথে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় মেতে উঠে সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে নিঃস্ব হয়েছি! এই প্রশ্নগুলোই পাতার পর পাতা জুড়ে। বিস্মৃতিপ্রবণ জাতির ঘাড়ে স্মৃতি বারংবার নিঃশ্বাস ছাড়ে।
যুদ্ধের বীভৎস রূপকে বর্ণনা করতে আলা রেনের 'হিরোশিমা মন আমুর' ছবির রেফারেন্স লেখায় উঠে আসে। সমগ্র লেখা জুরে বিভিন্ন সিনেমার-সাহিত্যের রেফারেন্স। এভাবে কখন যে চলচ্চিত্রের চরিত্ররা বইয়ের চরিত্র হয়ে মিশে যায় মনেও থাকেনা। লেখকের বাবা-মায়ের বিয়ের দৃশ্য অবচেতন মনের কোনে 'অপুর সংসার' ছবির দৃশ্য হয়ে ধরা দেয়। ঠিক যেন অপু ও অপর্ণার বিবাহ! উদ্বাস্তু হয়ে আসা একটা ছেলের জীবনে একপশলা রোমান্টিকতা। যে ছেলেটির স্কুল সার্টিফিকেটে একদিন শিবহাটি হাইস্কুলের হেডমাস্টার লিখে দিয়েছিল সহায়হীন রিফেউজি ছে্লেটি আশানুরূপ ফল না করতে পারলেও সে পরিশ্রমী, সৎ। তাকে যেন উপযুক্ত সুযোগ দেওয়া হয়। চোখের সামনে একপলকের জন্য 'অপরাজিত' ছবির স্কুল হেডমাস্টারের সাথে অপুর কথোপকথনের দৃশ্য ভেসে আসে। গল্পের গতিমেয়তার সাথে বিভিন্ন সিনেমার চরিত্র, দৃশ্যরা পাতাজুড়ে জায়গা করে নেয়। মেঘে ঢাকা তারার নীতা, বাইশে শ্রাবণের মালতী, পথের পাঁচালীর অপু এবং দেশছাড়া-স্বজনহারা মানুষজনগুলোর জীবন মিলেমিশে হয় এক। সবকটা চরিত্রই ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে একমঞ্চে দণ্ডায়মান।
দেশছাড়া মানুষগুলো আলো না আসা ভাড়ার ঘরে পাশাপাশি সহাবস্থান করার ফাঁকে নিজেদের দেশকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতো। ফেলে আসা দেশ তাদের অবচেতনে রাখত আচ্ছন্ন করে। তাই লেখকের যেদিন প্রথমবার সুযোগ এলো বাংলাদেশ যাওয়ার, সে পারভেজ ভাইকে অনুরোধ করে দেখা করে নেয় 'গায়েত্রি সন্ধ্যা'র লেখক সেলিনা হোসেনের সাথে। ততদিনে লেখকও যে বুঁদ পূর্বপুরুষের দেশ ছাড়ার কাহিনীতে। বাড়ির অন্ধকার কোণে বাসা করে নিয়েছে সেই কিসসা। সেলিনা আপাও যে তার বইজুড়ে বর্ণনা করেছে দুই দেশের ভিটেমাটি হারানো অসহায় মানুষের কাহিনী। সেই গল্প মনন জুড়ে বুঁদ করে। তাই বন্ধু দেবালয় সেই দেশের মাটি নিয়ে আসে আই সি ইউতে থাকা ঠাম্মির জন্য, মৃত্যুশয্যায় শায়িত মানুষের শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে। মেখলা-দেবালয়ের ঠাম্মি একদিন দেশভাগকালে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে ছোট ছেলের ও কোলের মেয়েকে নিয়ে কাঁটাতার পেরিয়ে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল এপারে। অনেক লড়াইয়ের পর থিতু হতে পেরেছিল এদেশে। শেষ যাত্রায় একপ্রকার জন্মভুমিকে ছুঁয়ে দেখা।
লেখকের বাবার তোলা ছবিগুলই ইটের মতো থরেথরে সজ্জিত হয়ে স্মৃতির আকারে
কাহিনী হয়ে বই আকারে প্রকাশ পেয়েছে। সামান্য বেতনের স্কুল মাষ্টার নিজের
সন্তানদের হাতে বিলাসের সামগ্রি না তুলে দিতে পারলেও বই পড়তে শিখিয়েছেন।
ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে গেছেন পাবলিক লাইব্রেরি ঘোরাতে। মানবিক বিকাশের
জন্য ভালো চলচ্চিত্রের ভূমিকা উপলব্ধি করিয়েছেন। বিলাস-ব্যসন সামগ্রি হতে
যা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়কালের মানুষজনের জীবনের আপাত সাধারণ টুকরো
টাকরা কথা পড়লে বুঝবো আমাদের ভালভাবে বাঁচার অর্থের প্রয়োজন ছিল অতি সামান্য ।
দেশের আসল সংজ্ঞা কি? দেশের প্রতি ভালবাসা আসে কিভাবে? প্রত্যেকের কাছে আছে দেশের নিজস্ব সংজ্ঞা। সেই ভালবাসা জোর করে আসেনা, এমনি আসে মন থেকে। যেমন বড় মণির ছিল একটুকরো দেশ। টুক করে সে হারিয়ে যেত মাঝে মাঝে। হাঁদার ছিল একটা চায়ের দোকান। এদেশে নিঃস্ব হয়ে উপযুক্ত কিছু না পেয়ে স্বনির্ভরতার রাস্তা সে নিজেই খুঁজে নিয়েছিল। সে নিজের দেশ খুঁজত খুব কষ্টে টাকা জমিয়ে, ধারবাকি করে কেনা একটা সাদাকালো টিভিতে। কোনোভাবে সিগন্যাল পেয়ে আসা বাংলাদেশের অস্পষ্ট ঝিরঝিরে চ্যানেলে। কিচ্ছু দেখতে না পেলেও অনভুতি দ্বারা সে পাড়ি দিত তার দেশের বাড়িতে। ঠিক যেমন দেশভাগ কোনভাবে মানতে না পেরে ঋত্বিক ঘটক বারবার সিনেমার ক্যানভাসে আঁকত তার মর্মান্তিক পরিণতি। মণি, হাঁদা ও তাদের মত কতো যে অসংখ্য মানুষ সবকিছু থাকতেও সম্পূর্ণ হারিয়ে, মনের পূর্ণ না হওয়া অনেক আশা নিয়ে চোখ বুজল তার খবর আমরা কে রেখেছি? আসলে আমরা কোন কিছুই মনে রাখতে চাইনি। উদার অর্থনীতির প্রমোদতরিতে ভেসে পাড়ি দিয়েছি বিস্মৃতির দেশে। ক্ষমতাবানরা স্মৃতি নামক ধারালো অস্ত্রকে আপ্রাণ চেষ্টা করে ভোঁতা করে দিতে। নিজের শিকড় ভুলবো না আগলে রেখে শান দেবো, সিদ্ধান্ত নেব নিজেরাই।
বইটি পড়তে পড়তে নষ্টালজিয়ার তরীতে পাড়ি দিয়ে তরতর করে ভেসে বেড়াতে থাকি। এক নিমেষে না পড়ে ফেলা অব্দি হুঁশ থাকেনা। একসময় শেষ হয় গল্পের ঝুলি। অনভুব করি অজান্তে লেখকের ব্যাক্তিগত পরিসরে সাজিয়ে নিয়েছি নিজের আশেপাশের চরিত্র, অভিজ্ঞতা। গল্প শেষ হলে ধুলো ঝেড়ে খুলে বসি পুরানো ছবির অ্যালবাম। খুঁজে নিতে থাকি মানুষগুলোর যৌবন, নিজের শৈশব আর দেখা-না দেখা ঘটনাবলী। নতুন করে চিনতে শুরু করি নিজেকে। শুধু একটাই অভিযোগ রয়েছে বইটিকে নিয়ে। শেষের পরিচ্ছদ কি অন্যভাবে শেষ করা যেত না? অন্যান্য পরিচ্ছদের গতিমেয়তার সাথে আরেকটু যদি সাযুজ্য রাখা যেত বেশ লাগতো। কিংবা লেখক জ্ঞ্যানত বুঝেশুনেই এইভাবে সমাপ্তি টেনেছেন। বইয়ে পাতার পর পাতা জুড়ে লেখকের পারিবারিক ছবি এবং তার সাথে শিল্পী মেখলা ভট্টাচার্যের ইলাসট্রেশন ও কোলাজ গল্পের গতিমেয়তাকে যথাযথভাবে অবয়ব প্রদান করেছে। এইরকম একটা বিষয়বস্তু চমৎকার বই হয়ে উঠতে পারে ভাবতেও অবাক লাগে।
Comments
Post a Comment